আগামী বছরই দেশের প্রতি ১০ জনে একজন হবেন প্রবীণ

দ্রুত প্রবীণ সমাজে রূপান্তরিত হতে চলেছে বাংলাদেশ। আগামী বছর নাগাদ দেশের প্রতি দশজন নাগরিকের মধ্যে অন্তত একজনকে পাওয়া যাবে, যিনি প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জনমিতিক এই পরিবর্তনের ফলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের চাপের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ, ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী হবেন। শতাংশের হিসেবে যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ ভাগ। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচজনে একজন নাগরিকের বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ বয়স্ক মানুষ নানাবিধ জটিল শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে প্রবীণদের সহায়তা কাঠামো দুর্বল হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে নারীরা অসুস্থতা, অক্ষমতা এবং অবৈতনিক যত্নশ্রমের কারণে অধিকতর ঝুঁকির মুখে রয়েছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে বার্ধক্য নিয়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও নীতিমালায় পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। সংস্থাটি মনে করে, বয়স বাড়াকে কেবল ‘নির্ভরশীলতা’ হিসেবে দেখার পুরোনো মানসিকতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রবীণদের সমাজের বোঝা না ভেবে সম্পদ হিসেবে বিবেচনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত ‘৯ম গ্লোবাল সিম্পোজিয়াম অন লো ফার্টিলিটি অ্যান্ড এজিং’-এ এই বৈশ্বিক সংকট ও সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা হয়। ইউএনএফপিএ এবং কোরিয়ার ডেটা ও পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয় (এমওডিএস) যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে নিম্ন জন্মহার এবং দ্রুত বার্ধক্যের বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়।

সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা জেন্ডার বা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ওপর বিশেষ জোর দেন। তারা জানান, গড় আয়ুতে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমুখী। আয়ের বৈষম্য, পেনশনের অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করেই তাদের জীবন কাটে। এছাড়া পরিবারে তাদের অবদান অনেক সময় অদৃশ্য থেকে যায় বা তারা সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হন।

ইউএনএফপিএ-এর মতে, অনেক প্রবীণ ব্যক্তি বাস্তবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল নন, বরং তারা স্বেচ্ছাসেবী কাজ, আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জোরালো ভূমিকা রাখছেন। তাই বয়স্কদের ‘ডিপেনডেন্সি’ বা নির্ভরশীলতার তকমা দেওয়া বড় ভুল। সবাইকে নিয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ ও সুস্থ জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরি করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ’র ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত) পিও স্মিথ বলেন, ‘জনমিতিক এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আমাদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও সংহতি প্রয়োজন। যৌথ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলে যেকোনো বয়সের মানুষ পরিপূর্ণ জীবন উপভোগ করতে পারবে।’

অন্যদিকে কোরিয়ার এমওডিএস-এর মহাপরিচালক ইয়াং সুন পিল বিষয়টিকে বৈশ্বিক কাঠামোগত পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বিশ্বের প্রতিটি দেশ কম-বেশি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, কেবল পরিবর্তনের গতি ভিন্ন।

কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য শক্তিশালী ও আধুনিক ডেটা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে ইউএনএফপিএ। সংস্থাটি তাদের নতুন গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানে জনশুমারি ও সঠিক তথ্য সংগ্রহের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নীতিনির্ধারক ও গবেষকরা একমত হয়েছেন যে, নিম্ন জন্মহার বা বার্ধক্য মোকাবিলায় কোনো জবরদস্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা যাবে না, বরং নারীর অধিকার ও লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করেই জনমিতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হবে।