শিক্ষাবিদরা বলছেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা, দ্বিমত নেই ইউজিসির

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। কখনও কখনও অভিভাবকরাও ছুটছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত ভ্রমণ, যাত্রাপথে যানজট, থাকা-খাওয়ার কষ্টসহ হাজারও প্রতিকূলতায় জর্জরিত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের রাস্তা। ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা হয়রান। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে শিক্ষাবিদরা বলছেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের নানা ভোগান্তি নিয়ে ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব। লিখেছেন- যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ ও এম.এস.আই. খান।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছেন না বরেণ্য শিক্ষাবীদ ও এমিরিটাস অধ্যাপক ড. এ এফ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা সবার প্রথমে নেয়া উচিত। এরপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং সবার শেষে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমার মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছি না। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের এ দুর্ভোগের দায়ভার ইউজিসির। তাদের উচিত পরিকল্পনা নিয়ে এ সমস্যার একটা সমাধান বের করা। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে সব প্রতিষ্ঠানে ইউনিটভিত্তিক আলাদা আলাদা আবেদন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের যে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে, তা একেবারেই অযৌক্তিক। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে প্রকৃতপক্ষে লাভবান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের। তাই পরীক্ষার ফি কমানো উচিত আর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া উচিত।

ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মাসিক শিক্ষা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. আয়েশা বেগম বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে হয়। এতে যে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয় সেটি সহজেই বোঝা যায়। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। কাজেই বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনা করে এবং শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময় সেশন জটের সমস্যা ছিল। তারা একটা পরিকল্পনা নিয়ে সেই সমস্যার একটা সমাধান করতে পেরেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রম সহজে আলোর মুখ দেখবে না। হয়তো সময় লাগবে। ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সবার মিলে বিষয়টির সমাধার করা উচিত। তাহলে কল্যাণ হবে শিক্ষার্থীদের, হবে সীমাহীন দুর্ভোগের সমাপ্তি।

বিশিষ্ট কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই সাবজেক্ট ভিন্ন ভিন্ন নামে রয়েছে। যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সেটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান, আবার জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি! বিষয়গুলো মোটামুটি একই, পার্থক্য অতি সামান্য। অবশ্যই এই সমস্যা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। তবে সমস্যা সমাধানে বিষয়গুলোকে সমমানের করার উদ্যোগ নেয়া উচিত ইউজিসির। সমন্বিত পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় পছন্দের জন্যও একটা অনলাইন আবেদন থাকতে পারে, থাকবে পছন্দক্রম। শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ পূরণ না হলে পরবর্তী পছন্দের জায়গায় চলে যাবে। এভাবে  সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

কি বলছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি): বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ্ নওয়াজ আলি বলেন, 'উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। অভিভাবকদের আর্থিক ব্যয়ের পাশাপাশি পোহাতে হয় নানা ধরণের ভোগান্তি। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অবগত আছে। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভোগান্তি লাঘবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতির কথা বলেছেন। আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। সব বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে এলে মেডিকেলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা সম্ভব।'

তিনি বলেন, 'দেশের প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত কাজেই তাদেরও কিছু নিয়মকানুন আছে। আমরা বেশ কয়েকবার সমন্বিত পরীক্ষার ব্যাপারে দেশের সব ভিসির সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছিলাম। এখনও সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইউজিসির চেয়ারম্যানও আগ্রহী। কাজেই সামনে ফলপ্রসূ কিছু হতেই পারে। সকলের মত আমরাও চাই শিক্ষার্থীরা ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ পাক, তাদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম হোক।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন বলেন, 'আপনারা জানেন, গত বছর ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন হস্তান্তরের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। পরে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে যথাযথ উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর বিষয়টিতে অগ্রগতি হয়নি।'

আখতার হোসেন বলেন, '২০১৪ সালে যশোর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিতভাবে পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে কাজ করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন প্রতিবন্ধকতা আছে। তবে আমরা আশাবাদী। মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং ইউজিসির চেয়ারম্যানের আগ্রহে বিষয়টার সমাধান হতে পারে।'

তিনি জানান, ইতোমধ্যে ইউজিসি দেশের সবগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে কথা বলেছে। সমন্বিত পরীক্ষার ব্যাপারে সবাই একমত। আগামী বছরই হয়তো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা এক ফর্মের মাধ্যমেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। সামনের দিনগুলো এ বিষয়ে অগ্রগতি আরো দৃশ্যমান হবে। এভাবেই সামনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারে। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সম্মানীত শিক্ষক, বিশিষ্ট সাংবাদিক, সুধীজন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্টদের ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

১ম পর্ব: আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষার্থী-অভিভাবক হয়রান

২য় পর্ব : ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তি: সমন্বিত পরীক্ষায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়িমসি