নির্বাচনে জিতে আনোয়ার ইব্রাহিমকেই প্রধানমন্ত্রী করবেন মাহাথির!

মালয়েশিয়ার নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। রোববার এ ঘোষণায় মাহাথির মোহাম্মদকে প্রধানমন্ত্রী ও আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহকে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দেয়া হয়।

১৯৯৬ সালে আনোয়ার ইব্রাহিম ও মাহাথির মোহাম্মদ।  ছবি: এএফপি

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এমন ঘোষণা স্বাভাবিক ছিল না। কারণ, আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতেই ছিল প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়নের মূল ক্ষমতা। বিনা অপরাধে তাকে জেল খাটানো মাহাথিরকে তিনি কিভাবে তার নেতৃত্বাধীন জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেন? আনোয়ার তা-ই করলেন। দল ও দেশের স্বার্থে নিজের কষ্টের অতীত ভুলে মাহাথিরকেই প্রার্থী হিসেবে মেনে নিলেন!

কাঁদলেন মাহাথির: আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন ঘোষণার পর আবেগে আপ্লুত হয়ে যান মালয়েশিয়ার উন্নয়নের রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ। নাম ঘোষণার পর উপস্থিত দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন ৯২ বছর বয়সী এ নেতা। এসময় পাশে থাকা তার স্ত্রী সিতি হাসমান কেঁদে ফেলেন। চোখ মুছতে থাকেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে মাহাথিরের স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী আজিজাহ। তিনিও কেঁদে ফেলেন। হলরুমের অনেকের চোখের কোনায় অশ্রু। এমন দৃশ্যে নিজেকেও ধরে রাখতে পারেননি মাহাথির মোহাম্মদ। টলমল চোখ নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে কান্না আড়ালের চেষ্টা করেন তিনি।

কিছুক্ষণ পর বক্তব্য দেয়ার জন্য মঞ্চে যান মাহাথির। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি আনোয়ারের কাছে ঋণী। তার অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি। যখন আমার সরকারের সময়ে তাকে সুনগাই বুলো কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তখন ওর কেমন লেগেছে তা আমি এখন অনুভব করছি। গত ২০ বছরে তার পরিবার নানা ভোগান্তির শিকার হয়েছে। আমি তাদের অনুভূতিটাও বুঝতে পারছি। আমাকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত তার জন্য খুব সহজ ছিল না।’

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রার্থী মনোনয়নের পর বক্তব্য রাখছেন মাহাথির মোহাম্মদ। ছবি: এএফপি

মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা এখন একের অন্যের সাথে হাত মিলিয়েছি। কিন্তু তার পক্ষে আমাকে মেনে নেয়া সহজ নয়। কারণ আমি তখন নেতৃত্বের অংশ ছিলাম। এ কারণে আজকের সিদ্ধান্ত নিতে আমরা অনেক সময় নিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত আনোয়ার ইব্রাহিম আমাদের দেশের জন্য করা সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।’ তার এ বক্তব্যে হলরুম করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে।

যেভাবে প্রধানমন্ত্রী হবেন আনোয়ার ইব্রাহিম: মাহাথিরের বক্তব্যের পর জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, নির্বাচনে জিততে পারলে তাদের সরকারের প্রথম কাজ হবে আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থা করা। আর আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে দেয়া। দলের সেক্রেটারি সাইফউদ্দিন আবদুল্লাহ জানান, আনোয়ার ইব্রাহিমকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য উপযুক্ত হবেন। মাহাথির টানা ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতার প্রতি তার আর কোনো মোহ নেই। তাই তিনি নিজ থেকেই সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাকে হাল ধরতে হয়েছে। নির্বাচনে জেতার পর তিনি তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিযোগী আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ তিনিই খুলে দেবেন।

মাহাথির-আনোয়ারের বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস: মালয়েশিয়ার রাজনীতি বললেই ভেসে আসে দুই নাম। একজন কিংবদন্তি মাহাথির মোহাম্মদ আরেকজন ইসলামপন্থী আনোয়ার ইব্রাহিম। ৯০ এর দশকে এ দুই রাজনীতিক একসঙ্গে ছিলেন। রাজনৈতিক মাঠে তাদের মিত্রতা ছিল। কিন্তু সেটি বেশি টেকসই হয়নি। এক সময় দুইজনের মধ্যে আদর্শগত কারণে দূরত্ব তৈরি হয়। এক পর্যায়ে আদর্শিকভাবে একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এজন্য পশ্চিমা ভাবাপন্ন মাহাথিরকেই দায়ী করেন। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ইসলামপন্থী আনোয়ারের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করেন। সততার প্রশ্নে আপোষহীন ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসেবে পরিচিত আনোয়ারের বিরুদ্ধে হাস্যকর অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ এনে তাকে জেলে পাঠায় মাহাথির সরকার। এ কারণে মানবাধিকার সংগঠন ও ইসলামপন্থীদের কাছে তীব্র সমালোচিত হয় তৎকালীন সরকার।

ফের কারাগারে আনোয়ার ইব্রাহিম: অনেক বছর জেল খেটে মুক্তি পাওয়া আনোয়ার ইব্রাহিম আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দল ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবারও সমকামিতার মতো হাস্যকর অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। পরে জনপ্রিয় এ ইসলামপন্থী নেতাকে দণ্ডিত করা হয়। বর্তমানে আনোয়ার কারাগারে রয়েছেন। ৮ জুন তার কারাভোগ শেষ হবে। মুক্তি পেলেও দেশের আইন অনুযায়ী, কারাভোগ শেষে ৫ বছর পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে তাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে যাবে।

নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি: নাজিব রাজাকের সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় এখন আন্দোলন তুঙ্গে। যদিও নাজিব রাজাক তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জেরুজালেম ইস্যুতে এরদোয়ানের মতো তিনিও ট্রাম্পের সমালোচনামুখর হয়েছেন। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডও তাকে সংশয়মুক্ত করতে পারছে না। কারণ নাজিবের বিরুদ্ধে সাড়ে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এজন্য তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।

এদিকে আগামী নির্বাচনে তাকে মোকাবেলার জন্য বিরোধীদলগুলো জোট গঠন করেছে। সেই জোটের প্রধান নেতা হচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তাতে যোগ দিয়েছে মাহাথিরের দলও। নির্বাচনের তারিখ এখনো ঘোষণা করা না হলেও আগামী আগস্টের মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সূত্র: মালয়েশিয়াকিনি ও গার্ডিয়ান