ঈদ যাত্রাই অন্তিম যাত্রা: ২৪ দিনে ঝড়ল ৩৮৭ প্রাণ

ঈদ, আনন্দের উৎসব। পরিবারের সঙ্গে এই আনন্দ ভাগাভাগি করতে দূরের মানুষও ছুটে যান স্বজনদের কাছে। উৎসব শেষে আবার আনন্দঅশ্রু নিয়ে ফিরে আসেন কর্মস্থলে। কিন্তু এই আনন্দ উৎসবে যাওয়া-আসার পথই প্রতিবছর বহু মানুষের জীবনে হয়ে যায় শেষ যাত্রা। চিরদিনের জন্য প্রিয়জনকে মলিন মুখে বিদায় জানাতে হয় স্বজনদের। আর যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তাদের বাকি জীবনটা হয়ে ওঠে বেদনাময়।

চলতি বছর ১৫ রমজান (১ জুন) থেকে ঈদের অষ্টম দিন (২৪ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩১০টি। এতে ৩৮৭ জন নিহত ও ৮৯১ জন আহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় ৫৩ জন নারী ও ৫০ জন শিশু রয়েছে। অর্থাৎ এ বছর ঈদুল ফিতরের আগে-পরে (২৪ দিনে) গড়ে ১৬ দশমিক ১২ জন নিহত এবং ৩৭ দশমিক ১২ জন করে আহত হয়েছেন।

এবারের ঈদযাত্রায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে গত শুক্র ও শনিবার। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২২ জুন শুক্রবার থেকে ২৩ জুন শনিবারের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৬৬ জন নিহত ও ১৮৩ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩৯ জনই পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি। এর মধ্যে শনিবার ভোরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে ১৮ জন নিহতের ঘটনা এখন পর্যন্ত এবারের ঈদের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।

বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে জাতীয় মহাসড়ক, আন্ত:জেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি জুন মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত বছরের প্রথম ছয় মাসে সড়কপথে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা দুই হাজার ২৩৬টি। এতে মোট দুই হাজার ৩৮২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর মোট আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৬৩ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৩০৪ জন ও শিশু ৩০৮ জন।

এনসিপিএসআরআর- এর তথ্যানুয়ী, গত বছর ঠিক একই সময়ে বছরের প্রথম ছয় মাসে (১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত) এক হাজার ৯৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ২৯৭ জন নিহত ও পাঁচ হাজার ৪৮০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ২৯২ নারী ও ৩১৫ শিশু ছিল। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর প্রথম ছয় মাস পূর্ণ হতে ছয় দিন বাকি থাকতেই দুর্ঘটনার সংখ্যা, নিহত ও আহতের পরিমাণ, সব কিছুই গত বছরের একই সময়ের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে

এ বিষয়ে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে বলেন, ’একদিকে ভরা দুর্যোগ মৌসুম, অন্যদিকে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মহাসড়কের নাজুক অবস্থা। তাই সরকার কঠোর না হলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি- দুটিই বাড়তে পারে বলে আমরা আশংকা করেছিলাম। টার্মিনালসহ সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে সকল সড়ক সংস্কার করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি জাতীয় মহাসড়ক ও আন্ত:জেলা সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকসমূহ চিহ্নিতকরণ, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধ ও জাল লাইসেন্সধারী চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, শ্রমিক-কর্মচারিদের নিয়োগপত্র ও সাপ্তাহিক ছুটি প্রদান, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও দৈনিক কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, চালক ও সহকারিদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ এবং বিদ্যমান মোটরযান চলাচল আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাবে না।’

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে বলেন, ‘সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রচুর ব্যয় করা হলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এর কারণ হল সড়ক নির্মাণে অনিয়ম। আমরা দেখেছি, একদিক থেকে সড়ক সংস্কার করে অন্যদিকে যাওয়ার পরই সংস্কার করা সড়কের পিচ উঠে যায়! ভাঙ্গা সড়ক, ট্রাফিক আইন না মানা ও চালকদের অনিয়মের কারণে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। আহতরা অনেকে পরিবারের বোঝা হয়ে বয়ে বেড়ান দুঃসহ এক জীবন।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে বলেন, ‘প্রতি বছর ঈদের সময় যাত্রাপথে বহু মানুষের প্রাণহানি কিংবা অঙ্গহানি ঘটছে। ফিটনেসবিহীন পুরানো গাড়ি রং চং করে দূরপাল্লায় যাত্রা করে নিয়ন্ত্রণ হারায়, অদক্ষ চালকদের কারণে এবং দীর্ঘ সময় টানা ড্রাইভিংয়ের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। ঈদের সময় যাত্রীচাপ বাড়লেও চালক বা গাড়ি কোনটার সংখ্যাই তেমন বাড়ে না। এই সুযোগে বাড়তি ভাড়া এবং দ্রুত ট্রিপ শেষ করার তাগিদেও অঘটন ঘটছে। প্রতিদিন বিভিন্নস্থানে নানা দুর্ঘটনার ফলে দেশের অর্থনীতির বড় ক্ষতি হচ্ছে। কর্মক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।