মৃত্যুর আগে শেষ পোস্টে কিংবদন্তির মর্মস্পর্শী কথা...

মাত্র দিন বিশেক আগে বিজয়ের মাসে সারা দেশে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো গাইবো বিজয়ের-ই গান...’ গানটি বাজছিল। এমন অনেক গানে সুরের জাদু দিয়ে এ দেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

মৃত্যুর আগে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সর্বশেষ ফেসবুক পোস্ট

তিনি একাধারে খ্যাতিমান গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা। এই কিংবদন্তি পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যাবার আগে আমাদেরকে ভালোবাসার ঋণের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)। এ খবরে যখন সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের কালো ছায়া। গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ৬৩ বছর বয়সী এই শিল্পীর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করেছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবিসহ শোকের অনুভূতি শেয়ার করছেন। এর থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

এ দেশের মানুষের ভালোবাসার প্রতি এই শিল্পীও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অন্যভাবে। মৃত্যুর আগে তিনি সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

এ কথার শেষেই বাংলাদেশের পতাকার আইকন জুড়ে দিয়েছেন শিল্পী। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তার হতে পাসপোর্ট ও বিমানের টিকেট ছিল। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আর কোনো পোস্ট দেননি তিনি।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। সুর দিয়েছেন কালজয়ী বিখ্যাত সব গানে। এ সব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সামিনা চৌধুরী, জেমসসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা।

শুরুর দিকে শিল্পীদের সঙ্গে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

তার লেখা ও সুর করা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেল লাইনের ধারে’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’।

এছাড়াও রয়েছে ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি’, ‘আমার মন কান্দে’, ‘আইলো দারুণ ফাগুনরে’, ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা’, ‘আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকবো’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বৌ সাজিয়ে’।

কম্পজিশনে ব্যস্ত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘কত মানুষ ভবের বাজারে’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘স্বামী আর স্ত্রী বানায় যে জন মিস্ত্রি’, ‘আমার জানের জান আমার আব্বাজান’, ‘ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘সাগরের মতই গভীর’, ‘আকাশের মতই অসীম’, ‘প্রেম কখনো মধুর’, ‘কখনো সে বেদনা বিধুর’, ‘আমার সুখেরও কলসি ভাইঙ্গা গেসে লাগবে না আর জোড়া’, ‘পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে’সহ এমন অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক, রাষ্ট্রপতির পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭১ সালে কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকায় ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

স্বজনরা জানান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল রাত দুইটার দিকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে আনার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ছেলে সামি জানিয়েছেন, তার পিতার মরদেহ আফতাবনগরের ২ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বরের নিজ বাসভবনে রাখা হয়েছে। নামাজে জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।