১৫২৮-২০১৯: পাঁচ শতাব্দীর টানাপড়েনের ‘এক পক্ষীয়’ সমাধান

বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির নিয়ে ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার টানাপড়েন দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শতাব্দীর। আর আইনি লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৩৪ বছর আগে। অবশেষে আজ শনিবার (৯ নভেম্বর) দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এ সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণা করেছে।

ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির তৎকালীন নেতাদের নেতৃত্বে উগ্রবাদী হিন্দুরা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাংচুর করে

রায়ে বলা হয়েছে, বিতর্কিত ওই জমিতে রামমন্দির নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ রায়ে কট্টরপন্থী তথা হিন্দুত্ববাদীদের জয় হয়েছে। এ নিয়ে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, মুসলিমদের ‘ঠাণ্ডা’ রাখতে অন্য স্থানে পাঁচ একর জমি দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে রায় ঘোষণার পর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুসলিম তথা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। ফলে এই রায়কে ‘এক পক্ষীয়’ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণের পর থেকে দীর্ঘ এই ৪৯১ বছরে নানা ঘটনার জন্ম হয়েছে। সেসব ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা টোয়েন্টিফোরলাইভ নিউজপেপারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

১৫২৮: অযোধ্যায় তৈরি হয় বাবরি মসজিদ। হিন্দুদের কিছু সংগঠন দাবি করতে শুরু করে মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে এই মসজিদ।

১৮৫৩: প্রথম এই ইস্যুতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়।

১৮৫৯: ব্রিটিশরা একটি প্রাচীর দিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের প্রার্থনার জায়গা আলাদা করে দেয়। এভাবেই ৯০ বছর ধরে প্রার্থনা চলে।

১৮৮৫: মহন্ত রঘুবীর দাস বাবরি মসজিদের বাইরে একটি অস্থায়ী মন্দির তৈরির দাবি জানান। ফৈজাবাদ কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়।

১৯৪৯: বিতর্কিত কাঠামোর বাইরে কেন্দ্রীয় ডোমের (গম্বুজ) নিচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়।

১৯৫০: জনৈক গোপাল সিমলা বিশারদ রাম লালার মূর্তি পূজার জন্য আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা কোর্টে আবেদন জানান।

১৯৫৯: এলাকার অধিকার দাবি করে নির্মোহী আখড়া মামলা করে।

১৯৬১: উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডও এলাকার অধিকার জানিয়ে পাল্টা আবেদন করে।

১৯৮৬ (১ অক্টোবর): স্থানীয় আদালত সরকারকে এক নির্দেশে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতি দিয়ে রামলালা যেখানে রয়েছে তার গেট খুলে দিতে বলে।

১৯৮৯: ভগবান শ্রী রামলীলা বিরাজমানের পক্ষে তার সখা এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি দেওকী নন্দন আগরওয়ালের আদালতে মামলা করেন।

১৯৯০ (২৫ সেপ্টেম্বর): অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী গুজরাটের সোমনাথ থেকে দেশব্যাপী রথযাত্রা শুরু করেন।

১৯৯২ (৬ ডিসেম্বর): বিজেপি নেতাদের নেতৃত্বে করসেবকদের একটি দল উন্মত্ততার সঙ্গে বাবরি মসজিদকে ধুলিসাৎ করে দেয়।

১৯৯৪ (২৪ অক্টোবর): সুপ্রিম কোর্ট ইসলাম ফারুকির মামলায় এক ঐতিহাসিক রায়ে প্রথম জানায় যে, মসজিদ ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়।

২০০২ (এপ্রিল): এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিতর্কিত স্থানের মালিকানা সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু করে।

২০১০ (৩০ সেপ্টেম্ব): এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২:১ সংখ্যাধিক্যের রায়ে বিতর্কিত জমিকে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দেয়।

২০১১ (৯ মে): সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার ভূমি বিবাদ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়।

২০১৭ (২১ মার্চ): সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে কোর্টের বাইরে সমাধান খোঁজার কথা বলেন।

২০১৭ (১ ডিসেম্বর): ২০১০ সালের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ৩২ জন সিভিল রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট মামলা করে।

২০১৯ (৮ জানুয়ারি): সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত ভূমি বিবাদ মামলার শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, শরদ অরবিন্দ বোরদে, এন ভি রমন, ইউ ইউ ললিত ও ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করে।

২০১৯ (২৫ জানুয়ারি): বিচারপতি ইউ ইউ ললিত এই মামলা থেকে সরে দাঁড়ানোয় সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, শরদ অরবিন্দ বোরদে, এস আব্দুল নাজির, অশোক ভূষন ও ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে বেঞ্জ পুনর্গঠন করে।

২০১৯ (২৬ ফেব্রুয়ারি): সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতার কথা জানায়। তিন সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি তৈরি করে দেয়।

২০১৯ (৯ মে): মধ্যস্থতাকারী কমিটি সুপ্রিম কোর্টে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে।

২০১৯ (১ আগস্ট): মধ্যস্থতাকারী কমিটি সিল করা খামে আদালতে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়।

২০১৯ (৬ আগস্ট): সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা ভূমি বিবাদ মামলার প্রতিদিন শুনানির কথা ঘোষণা করে।

২০১৯ (১৬ অক্টোবর): শুনানি শেষ ঘোষণা করে আদালত রায় সংরক্ষিত রাখে।

২০১৯ (৯ নভেম্বর): চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য, কট্টর হিন্দুদের বিশ্বাস, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ভগবান রামচন্দ্র জন্মেছিলেন। তার জন্মস্থান বলে চিহ্নিত জায়গায় ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট বাবরের আমলে একটি মসজিদ তৈরি হয়। যার নাম দেওয়া হয় বাবরি মসজিদ। মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি নিয়ে সেই থেকে হিন্দু-মুসলমানের যে বিবাদ চলছিল, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তা অন্যদিকে বাঁক নেয়।

কারণ ওই দিন কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। এ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অন্তত দুই হাজার লোক নিহত হন। সেই থেকে বাবরি মসজিদের ২ দশমিক ৭৭ একর জমির মালিকানা নিয়ে আইন লড়াই আরো জোরদার হয়।