তালেবানে মুগ্ধতা কাটছে না তমালের, বইও লিখবেন

যে তালেবান জুজুর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত চেহারায় ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছিলেন বিমানবন্দরের দিকে। যে তালেবানের ভয়ে পেটের মধ্যে কেমন যেন করছিল। যে তালেবানের অস্ত্র দেখে মনের জিজ্ঞাসা ছিল, অপহরণ করবে নাকি মেরে ফেলবে? সেই তালেবান সদস্যের মুখ থেকে যখন শোনা গেল, ভাইজান, ফিকর মাত করো। কুছ নেহি হোগা। হাম আপকা হেফাজত করেঙ্গে, খিদমত করেঙ্গে।

দেশে ফিরে বাবা-মায়ের সাথে তমাল ভট্টাচার্য

সবকিছু যেন এক লমহায় পাল্টে গেল শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্যের। আসলেই আর কিছু হয়নি। নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু মুগ্ধতা কাটছে না তার। মানবিক তালেবানের সে মুগ্ধতা। সে বার্তা অবশ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন ইথারে। আসার পর সবাই তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল, তালেবান তোমার ওপর চড়াও হয়নি তো? তখন তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে তিনি বাড়ি ফিরেছেন।

তিনি জানান, বাড়ি ফেরার পথে এ কে ৪৭, রকেট লঞ্চারসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তালেবান। তাই স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক ছিল চোখে মুখে। তখনই পাশ থেকে শোনা গেল এক তালেবানের কণ্ঠ। ভাইজান, ফিকর মাত করো। কুছ নেহি হোগা। হাম আপকা হেফাজত করেঙ্গে, খিদমত করেঙ্গে।

তালেবান সদস্যরা এখন নেমে পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে

চারদিকের গণমাধ্যমে যখন কেবল প্রমাণহীন তালেবানের অত্যাচারের কাহিনিতে সয়লাব, তখন এমনই ‘মানবিক তালেবান’-এর গল্প শোনালেন সদ্য ঘরে ফেরা শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য। গত রোববার রাতে তিনি নিমতায় তাঁর বাড়িতে ফেরেন।

বছর পঁয়ত্রিশের যুবক তমালবাবু পেশায় শিক্ষক। চলতি বছরের মার্চে তিনি কাবুল পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানে একটি স্কুলে বিজ্ঞান পড়াতেন তিনি। কিছুদিন সব ঠিকঠাকই চললেও কয়দিন ধরে তিনি টের পেতে থাকেন, দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। স্থানীয় লোকজন তমালকে তখনই দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর এদিকে কাবুলের পরিস্থিতি সংক্রান্ত নানা খবর দেখে উদ্বেগ বাড়ছিল পরিবারের সদস্যদের। এ অবস্থায় ১৪ আগস্ট চাকরি ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে অন্যরকম এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি। রাস্তায় অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আধা কিলোমিটার অতিক্রম করতে তার লেগে যায় প্রায় দু’ঘণ্টা।

তমাল বলেন, যে আবাসিক এলাকায় আমরা থাকি, সেখানেই একদিন অস্ত্র হাতে হাজির হয় কয়েকজন তালেবান সদস্য। আমি ছাড়াও সেখানে ছিলেন কয়েকজন ভারতীয় ও জিম্বাবুয়ে থেকে আসা শিক্ষক। তারা এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। প্রাণহানির কোনো আশঙ্কা নেই বলে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়। আমাদের ভয় করছিল। কিন্তু তালেবান যোদ্ধারা ভরসা দিচ্ছিল। তারা আমাদের পাহারা দেয়। ভালো বন্ধুর মত ব্যবহার করতে থাকে। এমনকি তারা আমাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল।

ক্রমশ কেটে গিয়েছিল প্রাথমিক ভীতি। পরে বন্দুকধারী তালেবান তাকে নিয়ে ছবিও তোলে। একসঙ্গে ক্রিকেট খেলাও হয়। আফগান নান, টিক্কা কাবাব খাওয়া হয় একসঙ্গেই। তালেবানের এমন ব্যবহারে হতবাক হয়ে যান সেখানকার শিক্ষকরা। আমাদের মনের অবস্থা বুঝেই যেন ওরা এসে বলে, ওস্তাদ! এখানে থেকে যান। ছাত্রদের তালিম দিন। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। কিন্তু তবুও আমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি তারা।

অবশেষে রোববার মাঝরাতে ভারতের বিমানবাহিনীর বিমানে দিল্লি হয়ে কলকাতায় নামেন তিনি। তালেবানি মুগ্ধতা জানিয়ে তিনি বললেন, কাবুল যাওয়ার আপাতত কোনো ইচ্ছা না থাকলেও সুযোগ পেলে ১৪-২২ আগস্টের ঘটনা নিয়ে বই লিখবেন তিনি।

এদিকে তমাল ভট্টাচার্য তার অনুভূতির সহজ প্রকাশ করলেও অনেকের জন্য তা বিব্রতকর হয়ে ওঠেছে। কারণ প্রমাণহীনভাবে লাগাতার তালেবানের বিরোধিতা করে আসা স্রোতের বিপরীতে তমালের এ ভাষ্য একেবারেই বেমানান হয়ে গেছে। প্রমাণ করে দিয়েছে, তালেবান জুজুর ভয় আসলে তাদেরই সৃষ্ট।