দুই সন্তান সরকারি চাকুরে, সংসারে ঠাঁই নেই বাবার!
- Details
- by নিজস্ব প্রতিবেদক
‘ওরা খোঁজ খবর নেয় না, তাও দোয়া করি। বাঁইচে থাকুক, বহুদিন বাঁইচে থাকুক তারা। মেয়েদেরকে দেখতে তো মন চায়। আমি তাদের নম্বর ভুলি গেছি। তবুও বলি আল্লাহ ওদের ভালো রাখুক।’ বৃদ্ধাশ্রমের বিছানায় বসে কথাগুলো বলতে বলতেই হু হু কান্না শুরু করেন ৭০ বছর বয়সী সেলিম মাস্টার।
শিক্ষক সেলিম হোসেন
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার পুরো নাম মো. সেলিম হোসেন। বাড়ি চট্টগ্রামে। বসয় ৭০ বছরেরও বেশি। ৩২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে চাকরি দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। বিয়ে দিয়েছেন চাকরীজীবী ভালো জামাই দেখে।
স্ত্রী মারা গেছেন ২০১৪ সালে। এরপর আর সংসারে ঠাঁই মিলেনি এই বৃদ্ধের। বিগত ৫ বছরের বেশি সময় ধরে থাকছেন বৃদ্ধাশ্রমে। দুই মেয়ে, মেয়ে জামাই কেউই খোঁজ নেয় না। তবুও মৃত্যুর আগে একবার সন্তানদের দেখা পেতে চান সেলিম মাস্টার।
শিক্ষক সেলিম হোসেন
রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকা সেলিম মাস্টারের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
সেলিম মাস্টার বলেন, ‘আমার নাম মো. সেলিম মাস্টার। বাড়ি চিটাগং (চট্টগ্রাম)। শিক্ষকতা করেছি ৩২ বছর। সংসারে আমার দুইটা মেয়ে আছে, কোনো ছেলে নাই। দুই মেয়েরই বিয়ে দিছি। তারা সরকারি চাকরি করে। মেয়ের জামাইরাও ভালো চাকরি করে।’
তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রী মারা গেছে ২০১৪ সালে। আমি রিটায়ার্ড করছি ২০১২ সালে। রিটায়ার্ড করার দুই বছর পরই স্ত্রী মারা গেলো। তখন মাইয়্যারা কেউই আর খোঁজ খবর নেয় না আমার। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াইছি। পরে আমার রাস্তায় থাকার ভিডিও ফেসবুকে দেইখা এখানে (বৃদ্ধাশ্রমে) লইয়া আইছে।
অশ্রুমাখা চোখে সেলিম মাস্টার বলেন, ‘২০১৭ সালে এখানে (বৃদ্ধাশ্রমে) আইছি। মেয়েরা খবর নেয় না। জামাইরাও খোঁজ নেয় না। নাতি আছে ২টা। তারা তো ছোট। কীভাবে খোঁজ নেবে তারা। মেয়েদের দেখতে তো মন চায়। আমি তাদের নম্বর ভুলি গেছি। খোঁজ খবর নেয় না তাও মেয়েদের জন্য দোয়া করি। বাঁইচে থাকুক, বহুদিন বাঁইচে থাকুক ওরা।’
মেয়েরা কে কী করেন জানতে চাইলে অভিমানের সুরে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা দুজনই সিটি করপোরশনে চাকরি করে, কেমনে আইবো তারা। তাদের তো সময় নাই। দুই মেয়েকেই চাকরি জোগাড় করে দিছি চিটাগং সিটি করপোরেশনে।’
মেয়ের জামাইদের কথা জানতে চাইলে সেলিম মাস্টার বলেন, ‘জামাইরাও দুজন চাকরি করে চট্টগ্রাম বন্দরে। আমার জীবনের আর কোনো চাওয়া নাই। মেয়েদের বিয়ে দিছি, তারা সুখে থাক। আমার শেষ সময়টা এখানেই (বৃদ্ধাশ্রমেই) কাটাতে চাই।’
‘আমি আইছি সেই ২০১৭ সালে। ৪-৫ বছর হয়ে গেলো। কেউ খোঁজ নেয় না। এখানেই খুব ভালো আছি আমি। বাড়িতে থাকলে বরং অসুখ হতো মরে যাইতাম দেখার তো কেউ নাই।’ বলতে বলতে আবারও কান্না শুরু করেন সেলিম মাস্টার।
আপনাকে যদি পরিবারের কাছে পাঠানো হয় যাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। যাবো কার কাছে। আমার তো পরিবার নাই। বলেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন’।
দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে পড়িয়েছেন, তারা কেউ খোঁজ নেয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই ভালো। এখন সবাই ব্যস্ত। কে আর মনে রাখছে আমারে। তবুও সবার জন্য দোয়া করি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদও আমার ছাত্র ছিলো। ওর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া সরফ ভাটায়। আমি ওই হাইস্কুলেই শিক্ষকতা করছি। স্কুলের নাম সরফ ভাটা হাইস্কুল।
‘এখন সবাই বড় বড় মানুষ হয়েছে আমার মত শিক্ষকের কি খোঁজ নেওয়ার দরকার আছে। না, নাই তো’ বলতে বলতে চোখ মোছেন সেলিম মাস্টার।
সেলিম মাস্টার সম্পর্কে ওই বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দার বলেন, ‘সেলিম মাস্টারকে আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে নিয়ে এসেছি। তিনি রাস্তায় পড়ে ছিলেন। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে গিয়ে তাকে এখানে এনেছি। তার একপাশ প্যারালাইজড হয়েছে। ঠিকমত হাঁটা-চলা করতে পারেন না।
অসহায় ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধদের জন্য পরিচালিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় শতাধিক বৃদ্ধ নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। এর মালিক মিল্টন সমাদ্দার। তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনেই পেশায় নার্স। চাকরির পাশাপাশি এই সেবামূলক কার্যক্রম গড়ে তুলেছেন তারা।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের অনেক সন্তান নিজের পিতা-মাতাকে সময় দিতে চায় না। তাদের খোঁজ খবর নেয় না। ফলে বৃদ্ধ বয়সে তারা অসহায় ও আশ্রয়হীন হয়ে যায়।
অসহায় ও আশ্রয়হীন এমন বৃদ্ধদের খুঁজে বের করে তাদের দায়িত্ব নেওয়াটা এখন আমার নেশা হয়ে গেছে। এছাড়াও রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া বৃদ্ধদের ভরণপোষণ করি আমি। মৃত্যৃর পর অনেক এমন অনেক বাবা-মায়ের দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও করি।
তার বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বৃদ্ধাশ্রমটি শুরু করেছিলাম। এখানে মোট ১২৫ জন বাবা-মা এবং তাদের সাথে ২৫ জন শিশুও রয়েছে। কোনো পরিকল্পনা করে এটা শুরু করিনি। রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধদের দেখে তাদের কষ্ট সহ্য হয়নি। তাই তুলে এনে আশ্রয় দেওয়া শুরু করেছিলাম।
একজন, দুজন করে আজ শতাধিক মানুষকে একই ছায়ায় রেখেছি। আমি মনে করি, মানুষ কখনো রাস্তায় পড়ে থাকতে পারে না। চেষ্টা করছি পরিচয়হীন, অজ্ঞাত, অসুস্থ, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী ও অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়াতে।’
মিল্টন সমাদ্দার আরও বলেন, ‘এখন আমাদের নিজস্ব একটি জমি হয়েছে সাভারে। সেখানে বিল্ডিং-এর কাজ চলছে। বয়স্ক ও অসহায় বৃদ্ধদের জন্য একটি নিজস্ব আশ্রয়স্থল গড়ে তোলাই এখন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.