চাপিয়ে দেয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো বুমেরাং হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য!

দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন দেশের ওপর দুম করে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে নিজের প্রভাব দেখানোর বিষয়টিই বেশি কাজ করে। কখনো ভেনেজুয়েলা, কখনো ইরান, কখনো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিশ্বের মোড়লিপনা করে আসা দেশটি। এখন রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতে সেই নিষেধাজ্ঞাগুলোই বুমেরাং হয়ে ফিরছে মার্কিনিদের দিকে।

রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া হামলা চালিয়েছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। সময়ের হিসেবে দুই সপ্তাহের বেশি। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর তিন হাজারেরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই নিষেধাজ্ঞাগুলো ভালোভাবে নেয়নি বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশটি। তারা ঘোষণা দিয়েছে, কোন কোন দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান করছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। এতে আগে থেকে আশঙ্কায় থাকা দেশগুলো রাশিয়ার এমন ঘোষণায় এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। হাঙ্গেরিসহ কিছু কিছু দেশ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করেছে।

ইউরোপের দেশগুলোর জন্য এটি অবশ্য অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কারণ বিশ্বে তেল-গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানি রপ্তানির দিক দিয়ে রাশিয়ার অবস্থান শীর্ষপর্যায়ে। শুধু মজুদের কারণে নয়, রপ্তানি অবকাঠামো, সহজলভ্যতা, প্রাচুর্য, দামের স্বল্পতা রাশিয়াকে জ্বালানি বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে।

রাশিয়ার একটি গ্যাস স্টেশন

বিশ্ববাজারে ইচ্ছে করলেই রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের পক্ষে এত দ্রুত রাশিয়ার বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আর গ্যাসের ক্ষেত্রে পাইপ লাইনের বিকল্প তৈরি করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। এর বিকল্প হিসেবে কিছু দেশে জ্বালানি পাওয়া গেলেও তা সংগ্রহ করতে বর্তমান খরচের তুলনায় তিনগুণ লেগে যাবে। করোনায় ধাক্কায় বিধ্বস্ত বিশ্বের ধনী-গরীব কোনো দেশের পক্ষেই এত ব্যয়ের বোঝা কাঁধে নেয়া সহজ হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তেল-গ্যাস উৎপাদক হলেও রপ্তানির তুলনায় আমদানিই বেশি করে। দেশটি চেষ্টা করলে নিজের উৎপাদন ও মজুদ ব্যবহার করে হয়তো অমুখাপেক্ষী অবস্থানে থাকতে পারবে। কিন্তু তার সাথে মিছিলে থাকা অন্য কোনো দেশের অবস্থাই যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুবিধাজনক নয়। ফলে এরই মধ্যে বিদ্রোহের সুর পাওয়া গেছে পিছনের সারিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে।

বিষয়টি আগেই আঁচ করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মিত্র হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কাছে ফোন করেছিল এ সব ইস্যুতে। কিন্তু স্রেফ উপেক্ষা করে দুই দেশ সেই ফোন কল এড়িয়ে গেছে। রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব বা ওপেকের বাধানিষেধের কথা বলে এ মুহূর্তে তারা জ্বালানি উত্তোলন বাড়াতে অনিচ্ছুক।

নিরুপায় হয়ে এর আগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ভেনেজুয়েলা ও ইরানের দ্বারস্থ হয়েছে বাইডেনের দেশ। এখানেও কয়েকটি বাধা রয়েছে। প্রথমত, দেশগুলো হয়তো এই সুযোগে নিজেদের দুর্ভোগের বদলা নেবে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের এমন পরিস্থিতিতে আগের গ্রাহককে বাদ দিয়ে অন্যত্র তেল বিক্রি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তৃতীয়ত, সুযোগ বুঝে যদি তারাও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে বসতে পারে। চতুর্থত, যাদের অবদানে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সফল করার চেষ্টা করবে, রাশিয়ায় নিশ্চয়ই সেটা নস্যাৎ করে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না। 

সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে পুরোনো শত্রুদের কাছে হাত পাতবে, না-কি নতুন আরোপিত এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে, সেটা নির্ভর করবে রাশিয়ার পরবর্তী চালের ওপর। রাশিয়া এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। তাতেই বিশ্বজুড়ে তেলের দাম ১০-১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার জবাবে একদিন যদি রাশিয়া পরীক্ষামূলকভাবে তার জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রাখে, তাহলেই মোড়লগিরি শেষ হয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের!