টি-শার্ট বিক্রেতা থেকে কোটিপতি প্রতারক!

মো. মশিউর রহমান। যিনি ই-কমার্স 'আকাশ নীল' প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এমডি। ছাত্রজীবন থেকেই তার ইচ্ছা ছিল নিজে বড় ব্যবসায়ী হবেন। তাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-তে অধ্যায়নের সময় একটি ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। ব্যবসা হিসেবে তিনি প্রথমে গার্মেন্টস থেকে রিজেক্টেড টি-শার্ট ও গার্মেন্টস পণ্য এনে নিউ মার্কেট এলাকায় বিক্রি করতেন।

গ্রেপ্তার মশিউর ও ইফতেখারুজ্জামান

কিন্তু এই ছোট ব্যবসায় তেমন সফল হতে পারেননি তিনি। এরপর তার মাথায় অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসলে তার অ্যামাজন, আলীবাবার মতো অনলাইনে ব্যবসার করার ইচ্ছা হয়। সেই চিন্তা থেকে শুরু করেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান 'আকাশ নীল'।

কিন্তু কিছুদিন পরই প্রতারণার করে লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যান মশিউর। সাম্প্রতিক সময়ে ওই প্রতরণার মূলহোতা অর্থাৎ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে গ্রেপ্তারের পর এসব কথা জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ‘আকাশনীল’ কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করে এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেন তারা। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঠাল বাগান এলাকায় একটি অফিস চালু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাক-সবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেন।

তবে করোনা মহামারির কারণে তারা ব্যবসা সচল রাখতে পারেননি। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ এর মে মাস পর্যন্ত ব্যবসা না করার কারণে যে পুঁজি দিয়ে অফিস সাজানো হয়েছিল তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয় কোম্পানি।

পরবর্তীতে মানুষের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অর্থ নিয়ে কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঠাল বাগান থেকে পান্থপথে স্থানান্তরিত করেন মশিউর। তার লিমিটেড কোম্পানি ছিল পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবসা, যাতে তার নিজের নামে ৭৭%, বোনের নামে ১০%, মাতার নামে ৮% এবং তার স্ত্রীর নামে ৫% শেয়ার রেখেছিলেন। তার এই পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবসায় তিনি ছিলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মা ছিলেন চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধু ইফতেখাইরুজ্জামান রনি ছিলেন ডিরেক্টর।

পরবর্তীতে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মোটরসাইকেলের অফার দিয়ে যখন রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিল তখন এই ধরনের ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে মোটরসাইকেল-ভিত্তিক অফারে ব্যবসা দিয়ে পুনরায় তারা যাত্রা শুরু করেন।

গ্রাহকদের আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল স্বল্প মূল্যে বা ডিসকাউন্টে প্রতিটি মোটরসাইকেলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত মূল্য ছাড়। এই ডিসকাউন্টের জন্যই সাধারণত গ্রাহকরা আকৃষ্ট হতো এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ মেইনটেন করতেন তারা। গ্রুপে মশিউর গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আশার বাণী, লোভনীয় অফার এবং মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান করতেন।

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা ১ম ক্যাম্পেইন করেছিল গত বছরের মে মাসে, যাতে ৩০% ছাড়ে ২ মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে ২ শতাধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পায়। পরবর্তী ক্যাম্পেইনে গত জুলাই মাসে ২৫% ডিসকাইন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় এক হাজারের অধিক মোটর সাইকেলের অর্ডার পায়। গত আগস্ট মাসে আকাশ নীল মোটরসাইকেলের ৩য় ক্যাম্পেইনে ২৩% ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে সরবরাহের আশ্বাসে ৯ হাজারের অধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পায়।

মোটরসাইকেলের পাশাপাশি তারা লোভনীয় ছাড়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, গৃহস্থালির অন্যান্য পণ্য বিক্রি নিয়েও অফার প্রদান করেছিল। গত সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা তার প্রদানকৃত অর্থ ফেরত চাইতে থাকে। গ্রাহকদের এরূপ চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত নভেম্বরে মশিউর অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।

র‍্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত ১৮ মার্চ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এক ভুক্তভোগী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশনীল’ এর এমডি এবং ডিরেক্টরসহ মোট ৯ জনের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০ মার্চ রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-২ এবং র‌্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে ফরিদপুর থেকে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আকাশ নীলের এমডি মো. মশিউর রহমান এবং পরিচালক ইফতেখাইরুজ্জামান রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, ওই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল। যাদের মাসিক ৪-৫ লক্ষ টাকা বেতন দেয়া হতো। কোম্পানির অর্থে ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাট আছে, যার বর্তমান মূল্য ৩ কোটি টাকা। ২টি দামি গাড়ি একটি প্রিয়াশ ও একটি সিএইচআর ব্যবহার করেন।

এ ছাড়া কোম্পানির ৪টি টাটা পিকআপ রয়েছে। বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে দেনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ৪টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে।