শরণার্থী গ্রহণে ইউরোপের ভয়াবহ জাতবিদ্বেষ

ইউক্রেনে হামলার পর থেকেই দেশটির শরণার্থীদের জামাই আদরে বুকে টেনে নিচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। সেই সঙ্গে জানাচ্ছে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা। কিছু দেশ ইউক্রেনীয়দের দুর্ভোগ লাঘবে সীমান্তে পরিবহণ ব্যবস্থা পাঠিয়েছে। কেউ আবার দেশে আসতেই চাকরির বন্দোবস্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশই তিন বছরের ভিসা পর্যন্ত অনুমোদন করেছে। তবে শরণার্থীদের ব্যাপারে ইউরোপে এর উল্টো চিত্রও আছে। আল জাজিরা।

ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সঙ্গে বাইডেন

শুধু যে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়োতেই এমনটি করেছে তা ভাববার অবকাশ নেই। কারণ ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাসের নাগরিকরা ইউক্রেনের চেয়েও ভয়াবহ সংকটে পড়েই শরণার্থী হয়েছিল। কিন্তু সে সময় বর্তমানের মতো অতি উদারতার কোনো পদক্ষেপই ইইউ দেশগুলো নেয়নি। উল্টো সীমান্ত পাহারা জোরদার করেছিল বেশিরভাগ দেশ। তাহলে এখন কেন নমনীয়?

বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের মুখ থেকে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে আজ শুক্রবার আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয়রা ইহুদি বলেই তাদের ক্ষেত্রে এতটা নমনীয় আচরণ করছে ইউরোপের দেশগুলো। শরণার্থী গ্রহণেও জাতবিদ্বেষী আচরণ করছে ইইউ। মুসলিম দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বেলায় তারা অত্যন্ত কঠোর।

শুধু তাই নয়, এসব দেশে থাকা ইহুদি ছাড়া অন্য জাত বা ধর্মের লোকদের দ্বিতীয় শ্রেণির শরণার্থী হিসাবে বিবেচনা করে সাধারণ জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট সরকার। যে গ্রিস ইউক্রেনীয়দের বুকে টেনে নিয়ে প্রশংসিত, সেই গ্রিসই সিরিয়ার একটি শরণার্থী দলের প্রতি অমানবিক আচরণ করে নিজেদের বর্বরতার এবং জাতবিদ্বেষী আচরণের প্রমাণ দিয়েছে। গ্রিসের সাহায্যকর্মী এবং আশ্রয়প্রার্থীরা সেসব দৃশ্যের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।

মধ্য মার্চের ঘটনা। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যবর্তী ইভ্রোস নদীর একটি দ্বীপে প্রবল শীতে আটকে ছিল ৩০ জনের একটি শরণার্থী দল। গ্রিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের। ওই দ্বীপে ফিরে যাওয়ার সময় নদীতে ডুবে মারা গেছে চার বছর বয়সী একটি শিশু।

পরে একটি গ্রিক পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় গ্রিসভিত্তিক অধিকার গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ৩৬০ এর আইনি হস্তক্ষেপের পর অবশেষে ১৬ মার্চ গ্রিক কর্তৃপক্ষ ওই নরক-দ্বীপ থেকে তাদের উদ্ধার করে। এই অধিকার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এপামিনন্ডাস ফার্মাকিস বলেন, অমানবিকভাবে দ্বীপে আটকে থাকা ৩০ সিরীয় শরণার্থীকে উদ্ধার করতে পারায় আমরা খুবই খুশি।

তিনি জানান, ওই দলে দুই গর্ভবতী মহিলা এবং সাতটি নাবালক শিশু ছিল। দ্বীপটিতে বেঁচে থাকার জন্য পানি, খাবার, চিকিৎসাসেবা কিছুই ছিল না। ছয় দিন ছয় রাত ধরে তারা ইভ্রোস নদীর ছোট্ট দ্বীপে আটকে ছিল।

কঙ্গোর বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী শরণার্থী জো এসকুয়ার (ছদ্মনাম) ইউক্রেনীয়দের ওরা খুবই আদর-আপ্যায়নে রেখেছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তারা ইউক্রেনের নাগরিকদের আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিজেরাই তৈরি করে দিচ্ছে। অথচ অন্যান্য নাগরিক বিশেষ করে মুসলিম দেশের লোকদের দ্বিতীয় শ্রেণির শরণার্থী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

গ্রিসের মতো পোল্যান্ডও মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদের তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর সেই পোল্যান্ডেই এখন ২৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৯ ইউক্রেনীয় শরণার্থী অবস্থান করছেন। আর রোমানিয়ায় আছে ছয় লাখ আট হাজার ৯৩৬ জন।

গ্রিক অভিবাসন মন্ত্রী নটিস মিতারাচি বারবার ইউক্রেনীয়দের ‘আসল শরণার্থী’ হিসাবে উলে­খ করেছেন। তার এভাবে বলার উদ্দেশ্য হলো, যেন গ্রিক মূল ভূখণ্ডে আসা অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের আশ্রয়প্রার্থীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, এসব শরণার্থীকে বিপদে ফেলতে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয় স্থানীয় প্রশাসন। কখনো মাদক নিয়ন্ত্রণ অভিযান, কখনো সন্ত্রাস দমন কিংবা কখনো বৈধ অভিবাসন কাগজপত্র পরীক্ষার নাম করে এসব শরণার্থীকে হেনস্তা করা হচ্ছে।