শুরুতেই জাত চেনালেন রুশ বাহিনীর নতুন কমান্ডার

মারকুটে ও আগ্রাসী জেনারেল হিসেবে নিজের যে পরিচিতি, দায়িত্বগ্রহণের প্রথম দিনেই তা দেখালেন ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর নতুন কমান্ডার সের্গেই সুরভিকিন। সকাল থেকে দফায় দফায় মিসাইল হামলায় কেঁপে উঠেছে রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের আধ ডজনের বেশি শহর। ভূগর্ভস্থ ট্রেন চলাচল, পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ, সেলফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি শহরে। কিয়েভে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউর দপ্তরের পাশাপাশি মিসাইল পড়েছে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অফিসের কাছেও। খবর তাস, রয়টার্স ও ইজভেস্তিয়া।

কিয়েভের বিভিন্ন টার্গেটে অন্তত তিন দফা ‍মিসাইল হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী

এক ভিডিওবার্তায় জেলেনস্কি সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, পুরো ইউক্রেনে বিমান হামলার সতর্কতা জারি রয়েছে। মিসাইল হামলা হয়েছে। মানুষ হতাহত হয়েছে। আমি আপনাদের কাছে মিনতি করছি, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বের হবেন না। নিজের ও প্রিয়জনের যত্ন নিন।

ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম স্ত্রানা জানিয়েছে, রাজধানী কিয়েভ ছাড়াও লভিভ, দনিপ্রোপেত্রোভস্ক, ইভানো-ফ্রানভিস্ক ও খারকিভ শহরে মিসাইল হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। একইসময়ে ড্রোন ও রকেট হামলা চালানো হয়েছে ওডেসা, ঝিয়ৎমির, কোরোসতিন, পোলটাভা, রিভনি ও খেমেলনিতস্কি শহরে। এসব হামলায় কিয়েভ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বুরশতিনস্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।

ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানান, রুশ সামরিক বাহিনী অন্তত পাঁচটি জায়গা থেকে ইউক্রেনের বিভিন্ন টার্গেট লক্ষ্য করে মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরে রুশ নৌযান থেকে প্রথম ২০ মিনিটেই ৪৭টি মিসাইল ছোঁড়া হয়েছে কিয়েভ ও অন্যান্য শহরে। 

কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিতেশকো বলেছেন, শহরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি মিসাইল হামলা হয়েছে। কিয়েভ মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে। সবকটি লেনে মেট্রো চলাচল বন্ধ করে ভূগর্ভস্থ রেল নেটওয়ার্ককে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে এবং সবাইকে সেখানে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। অনেক জায়গা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ থাকলেও ভোল্টেজ কমে গেছে। শহরতলীর ও বাইরের অধিবাসীদের রাজধানীতে না আসার অনুরোধ করা হচ্ছে।

উক্রেইনাস্কায়া প্রাভদা জানিয়েছে, দেশের মধ্যাঞ্চলে কিয়েভ, পশ্চিমাঞ্চলে লভিভসহ অনেক শহরে সেলফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অনেক জায়গায়। সাদোভায়া শহরের মেয়র কুজনেৎসভ বলেছেন, মিসাইল হামলার পর লভিভের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ করছে না।

ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান শহর ও কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লভিভের গভর্নর ম্যাক্সিম কাজাতস্কি বলেছেন, শহরের বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো লক্ষ্য করে রুশ বাহিনী বেশ কয়েক দফা মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। একইভাবে, খারকিভের মেয়র ইহর ওলেক্সান্দ্রোভিচ তোরেকভ বলেছেন, মিসাইল হামলায় খারকিভ শহরের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।

ইউক্রেনিয়ান রেলওয়ে জানিয়েছে, দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেলওয়ের কন্টাক্ট নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়েছে। এ কারণে কিছু ট্রেন বাতিল হতে পারে। চালু থাকা ট্রেনগুলোর শিডিউল বিপর্যয়ের ঝুঁকি রয়েছে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতায় কিয়েভ সেন্ট্রাল রেলস্টেশনের ছাদসহ বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সের্গেই সুরভিকিনকে কমান্ডার-ইন-চিফের দায়িত্ব দেওয়ার পরপর ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আক্রমণ গতি পেয়েছে

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অন্তত তিন দফা মিসাইল চালিয়েছে রুশ বাহিনী। দনিপার নদীর উত্তর ও দক্ষিণ উভয় তীরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়। প্রথম দফায় কমপক্ষে পাঁচটি মিসাইল কিয়েভের একেবারে কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিয়েভের ভলোদিরিস্কা স্ট্রিটে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউর একটি ভবনে মিসাইল হামলা হয়েছে। একই সড়কে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি স্থাপনাও মিসাইল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেভচেঙ্কিভস্কি ও ভলোদিমিরস্কা স্ট্রিটে মিসাইল হামলার স্থল থেকে আগুন ও ধোঁয়ার কু-লী উড়ছে।

সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া ভিডিওতে পেচেরস্কি স্ট্রিটে শহরের অন্যতম উঁচু ইমারত পারুস বিজনেস সেন্টারের পেছনে আগুন জ¦লতে দেখা যায়। পেচেরস্কি স্ট্রিটের পাশে বাঙ্কোভা স্ট্রিটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অফিস। মিসাইল হামলায় আক্রান্ত ভবন থেকে জেলেনস্কির অফিসের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটারেরও কম।

কিয়েভের কেন্দ্রস্থলে ইনডিপেনডেন্স স্কোয়ারে বিবিসির অফিস। আজ সকালে বিবিসি মর্নিং অনুষ্ঠানের সম্প্রচার চলাকালে সঞ্চালককে মিসাইল হামলার আওয়াজে ও ভয়ে ডেস্কের নিচে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, মিসাইল হামলার আগে কিয়েভে সতর্কতামূলক কোনো সাইরেন শোনা যায়নি। ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ার এসব মিসাইল শনাক্ত ও প্রতিহত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর আগে শনিবার প্রথমবারের মতো ইউক্রেন যুদ্ধে কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ক্রিমিয়া সেতুতে গাড়িবোমা হামলার ঘটনার পর সের্গেই সুরভিকিনকে ইউক্রেন কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিরিয়ায় রুশ কমান্ডের নেতৃত্বে থাকাকালে সুরভিকিন প্রচণ্ড আগ্রাসী ও মারকুটে কমান্ডার হিসেবে পরিচিতি পান। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই ক্রিমিয়া সেতুতে হামলার জন্য অভিযুক্ত ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউর দপ্তরে মিসাইল হামলা চালালেন সুরভিকিন।