গাজাবাসীকে অনাহারে রেখে সেনেগালিজদের মধ্যে কোরবানির পশু বিতরণ করবে ইসরায়েল!

প্রতি বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস ধর্মীয় ঐতিহ্য মেনে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে কোরবানির জন্য ভেড়া বিতরণ করে আসছে। তবে, চলতি বছর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী সেনেগালের জনগণকে দূতাবাসের এই উপহার প্রত্যাখ্যান করার জন্য জোর আহ্বান জানিয়েছে।

ইসরায়েলের পতাকা

‘সেনেগাল-প্যালেস্টাইন সলিডারিটি’ নামক একটি স্থানীয় সংগঠনের মুখপাত্র সালিউ বোকুম গত ২৩ মে এক বিবৃতিতে সেনেগালের জনসাধারণের প্রতি ইসরায়েলকে বয়কটের এই ডাক দেন। তিনি তীব্র ভাষায় বলেন, ‘এটি কোনো দান নয়, চলমান গণহত্যার মধ্যে এটি ইসরায়েলের একটি নির্লজ্জ পাবলিসিটি স্টান্ট।’

পরবর্তীতে ২৮ মে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ আরব’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বোকুম আরও বলেন, ‘আমরা শুধু এই বছরের ইসরায়েলি দূতাবাসের বিতরণ করা কোরবানির পশু প্রত্যাখ্যান করতে বলছি না, আমরা দূতাবাসের তথাকথিত সমস্ত দাতব্য উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে রমজানের খেজুর বিতরণ, যুব প্রশিক্ষণ এবং ইমামদের বিভিন্ন উপহার প্রদান। এগুলো আমাদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে পরিকল্পিত পাবলিসিটি স্টান্ট মাত্র।’

উল্লেখ্য, ডাকারের ইসরায়েলি দূতাবাস ২০০৬ সাল থেকে ঈদুল আজহার আগে দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে কোরবানির ভেড়া বিতরণ করে আসছে। এই অনুদান মূলত একটি বৃহত্তর প্রচার কর্মসূচির অংশ, যাকে ইসরায়েল সেনেগালের সঙ্গে তাদের 'উন্নয়ন সহযোগিতা' হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

তবে সেনেগাল-ফিলিস্তিন সলিডারিটি সংগঠনের বিশ্বাস, এই অনুদানের আড়ালে ইসরায়েলি দূতাবাস পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটির অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ইসরায়েলকে একটি হিতৈষী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

সাক্ষাৎকারে সালিউ বোকুম আরও যোগ করেন, ‘ইসরায়েল বয়কট অভিযানটি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেনেগালের বেশিরভাগ মানুষই জানেন না এই ভেড়া কোথা থেকে আসছে বা এর প্রকৃত অর্থ কী।’

তবে, বোকুম স্বীকার করেন যে সেনেগালের মতো একটি দরিদ্র দেশের জন্য এই বয়কট দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। তিনি বলেন, ‘এ দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দৈনিক ৩.২০ ডলারেরও কম আয় করে। ফলে, অনেক পরিবারের কাছে দানের ভেড়া গ্রহণ করা একটি সহজ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অপরিহার্য পছন্দ বলেও মনে হতে পারে।’ কিন্তু অ্যাক্টিভিস্টদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই ভেড়াগুলো গ্রহণ করার অর্থ হলো ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং গাজার শহীদদের ভুলে যাওয়ার শামিল।

ফিলিস্তিনপন্থী এই সংগঠনটি উল্লেখ করেছে, গাজায় চলমান গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের জন্যই দূতাবাস এই ধরনের দাতব্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক অভিযানে ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি, অবরুদ্ধ এই ছিটমহলে মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়ে প্রায় ২০ লাখ গাজাবাসীকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুকদের উদ্দেশ্যে বোকুম বলেন, ‘সবসময়ই এমন কিছু লোক থাকে যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গণহত্যাকারীদের সঙ্গেও হাত মেলাতে প্রস্তুত। এটি নাৎসিদের অধীনে ঘটেছিল এবং দুঃখজনকভাবে এখন আবার ঘটছে।’

ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সেনেগালিজদের অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। সেনেগাল ১৯৭৫ সাল থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার অনুশীলন সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির সভাপতিত্ব করে আসছে। তবে, অনেক আফ্রিকান দেশের মতো সেনেগালও অসলো চুক্তির পর পশ্চিমা মিত্রদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এবং উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।

এদিকে, গাজায় চলমান গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে সেনেগালের মানবাধিকারকর্মীরা ইসরায়েলের সঙ্গে অবিলম্বে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই বছরের শুরুতে ইসরায়েলের নতুন রাষ্ট্রদূত সেনেগালের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাসিরো দিওমায়ে ফায়ের কাছে তার পরিচয়পত্র পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে বোকুম বলেন, ‘গাজায় চলমান গণহত্যার কথা বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ নেওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। আমরা ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করি এবং তাকে বহিষ্কারের দাবি জানাই।’

চলতি সপ্তাহে, সেনেগাল-প্যালেস্টাইন সলিডারিটি সংগঠনের সদস্যরা ডাকারের শেখ আন্তা ডিওপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের একটি পূর্ব পরিকল্পিত সম্মেলন ভণ্ডুল করে দিতে বাধ্য করেছে। এছাড়াও, সংগঠনটি ডাকারে অনুষ্ঠেয় ২০২৬ সালের যুব অলিম্পিক গেমস থেকে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করারও জোর দাবি জানাচ্ছে। গ্রুপের মুখপাত্র বোকুম প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে যদি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে নিষিদ্ধ করা যায়, তবে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে না?’

সূত্র: দ্য নিউ আরব