প্রকৃতির রোষানলে বিপর্যস্ত মানব মন: জলবায়ু সংকটের এক অদৃশ্য মহামারি
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বিশ্বজুড়ে দাবানল, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং প্রাণঘাতী বন্যার মতো দুর্যোগ যখন মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, ঠিক তখনই বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনের এক নীরব সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন: মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর গভীর প্রভাব। বিশ্বের সব মহাদেশই বন্যা, দাবানল, চরম তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য জলবায়ু দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে, যা কোটি কোটি মানুষের ওপর তীব্র মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করছে।

স্নায়ু-মহামারীবিদ্যা ও স্মৃতিভ্রংশবিষয়ক শীর্ষস্থানীয় গবেষক ডোরিনা ক্যাডার আনাদোলুকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে’। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যারা বন্যা, দাবানল, ঘূর্ণিঝড় বা তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়ার সরাসরি শিকার হন, তারা তীব্র মানসিক চাপ ও আঘাতের সম্মুখীন হন। এর ফলে তাদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) দেখা দিতে পারে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ নেইল জেনিংসও জলবায়ু পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যেকার যোগসূত্রটির ঐতিহাসিক অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রান্থাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত জেনিংস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলছে’। তবে তিনি যোগ করেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই শারীরিক স্বাস্থ্যের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্য কম মনোযোগ পেয়েছে’।
মেজাজের পরিবর্তন থেকে আত্মহত্যার ঝুঁকি
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রায় পুড়ছে এবং আবহাওয়াবিদরা দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছেন।
ব্রাইটন অ্যান্ড সাসেক্স মেডিকেল স্কুলের কগনিটিভ এপিডেমিওলজি, ডিমেনশিয়া, অ্যান্ড এজিং রিসার্চ (সিডার) গবেষণাগারের পরিচালক ডোরিনা ক্যাডার বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণায় তাপপ্রবাহকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, অথচ এটি মেজাজের পরিবর্তন, আগ্রাসী আচরণ বৃদ্ধি, ঘুমের ব্যাঘাত এবং আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তির হার বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত’।
এই প্রভাবগুলোর পাশাপাশি নেইল জেনিংস উল্লেখ করেন যে, চরম তাপমাত্রা এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা জানি, প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আত্মহত্যার ঝুঁকি প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে যায়’।
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, মাসিক গড় তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত মৃত্যুর হার ২.২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধিও আত্মহত্যার হার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
জেনিংস জোর দিয়ে বলেন, কিছু নির্দিষ্ট পেশার মানুষ, যেমন—বাইরে কর্মরত শ্রমিক, নির্মাণকর্মী এবং কৃষকেরা অতিরিক্ত মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তিনি আরও বলেন, চরম তাপ, বন্যা বা দাবানলের কারণে ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষকেরা প্রায়শই উল্লেখযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক চাপের শিকার হন।
অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের বহু দিন পরেও মানুষের মধ্যে পিটিএসডি-র লক্ষণ দেখা যায়। ক্যাডারের মতে, ‘বাড়িঘর হারানোর মানসিক ধাক্কা এবং ধীর ও কঠিন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত তৈরি করতে পারে। গবেষণায় বন্যাদুর্গত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পিটিএসডি-র হার লক্ষ করা গেছে’।
একইভাবে দাবানলের কারণেও উদ্বেগ, হতাশা এবং মাদকাসক্তি বাড়তে দেখা যায়, বিশেষ করে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হন এবং উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি।
কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
যদিও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মানসিক অসুস্থতা যেকোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, গবেষণায় দেখা গেছে কিছু গোষ্ঠী বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
ডোরিনা ক্যাডার উল্লেখ করেন, বয়স্ক ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যারা স্মৃতিভ্রংশ বা হৃদ্রোগে ভুগছেন, তারা উচ্চঝুঁকিতে থাকেন। কারণ তাপপ্রবাহের সময় তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বা সহায়তা চাইতে সমস্যা হতে পারে। আগে থেকে মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরাও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তারা তাপজনিত অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণগুলো চিনতে বা সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের শীতলীকরণ যন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই, দুর্বল ব্যবস্থাপনার বাড়িতে বাস করেন বা বাইরে কাজ করেন, তারাও অতিরিক্ত ঝুঁকির সম্মুখীন হন। ক্যাডার আরও যোগ করেন, শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা পরিবেশগত পরিবর্তনে বেশি সংবেদনশীল হওয়ায় মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, শহরের মানুষেরা ‘নগর তাপ দ্বীপ’ প্রভাবের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে ঘনবসতিপূর্ণ অবকাঠামো এবং সবুজ স্থানের অভাবে শহরের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। ক্যাডার পুনর্ব্যক্ত করেন, ‘উচ্চ তাপমাত্রা হতাশা, উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক রোগের লক্ষণগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এমনকি আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে’।
জেনিংসও এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, চরম আবহাওয়ার সময় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর আশঙ্কা দুই থেকে তিন গুণ বেশি থাকে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘সিজোফ্রেনিয়ার মতো নির্দিষ্ট কিছু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা লিথিয়ামের মতো ঔষধ গ্রহণ করেন, যা তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে’। তিনি আরও জানান, ২০২১ সালে উত্তর আমেরিকায় তীব্র তাপপ্রবাহের সময় ‘মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন’।
অসমতা মানসিক স্বাস্থ্যের বোঝা বাড়াচ্ছে
বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন নিম্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে, যা মানসিক স্বাস্থ্য বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ক্যাডার বলেন, ‘পরিবেশগত অবক্ষয়ের সঙ্গে বসবাসের দীর্ঘস্থায়ী চাপ, বাড়িঘর হারানোর হুমকি, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বা খারাপ হতে থাকা বাতাসের মান ধীরে ধীরে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়’।
তিনি ‘জলবায়ু উদ্বেগ’ বা ‘পরিবেশগত উদ্বেগ’-এর ক্রমবর্ধমান প্রমাণের কথা তুলে ধরেন, যা মূলত গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভয় বা যন্ত্রণা দ্বারা চিহ্নিত। ক্যাডার বলেন, ‘এটি বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এবং যারা বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিবর্তনের মুখে নিজেদের অসহায় মনে করেন, তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়’।
সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তন বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং অর্থনীতির মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ব্যাহত করার মাধ্যমেও পরোক্ষভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। ক্যাডার বলেন, ‘যখন মানুষ তাদের জীবিকা হারায়, স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়, বা নিজেদের সম্প্রদায় ও প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে, তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। সুবিধাবঞ্চিত বা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষেরা প্রায়শই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ তাদের অভিযোজন এবং পুনরুদ্ধারের জন্য সম্পদ অনেক কম থাকে’।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.