দ্রুজ নেতা: লেবাননকে ইসরায়েলি চরমপত্র পৌঁছে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

লেবাননের প্রভাবশালী ড্রুজ নেতা ওয়ালিদ জুমব্লাত অভিযোগ করেছেন, সম্প্রতি বৈরুত সফরকারী একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল দেশটিকে ‘আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য একটি ইসরায়েলি নির্দেশ’ পৌঁছে দিয়েছে।

শুক্রবার ফরাসি ভাষার দৈনিক ‘ল’ওরিয়েন্ট-লে জুঁর’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন। লেবাননের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা (এনএনএ) জানায়, জুমব্লাত প্রতিনিধিদলের বার্তা স্পষ্ট ছিল উল্লেখ করে বলেন, ‘হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করুন, তারপর আমরা দেখব কীভাবে ইসরায়েলিদের সেনা প্রত্যাহারে রাজি করানো যায়’।

গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া দুই দিনের সফরে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি লেবাননের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করে। দলে ছিলেন সেনেটর জিন শাহিন ও লিন্ডসে গ্রাহাম, কংগ্রেসম্যান জো উইলসন, সিরিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন দূত টম ব্যারাক এবং জাতিসংঘে ওয়াশিংটনের মিশনের উপদেষ্টা মরগান অরটাগাস।

বৈঠকে লেবানন সরকারের অস্ত্র রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রাখার অঙ্গীকার এবং সর্বশেষ যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের দখল করা পাঁচটি অবস্থান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত ছিল।

প্রগ্রেসিভ সোশ্যালিস্ট পার্টির সাবেক প্রধান জুমব্লাত এই ‘চাপিয়ে দেওয়া আত্মসমর্পণ’ প্রত্যাখ্যান করে যুক্তি দেন, লেবাননের উচিত প্রথমে অধিকৃত অঞ্চল মুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া।

তিনি বলেন, ‘অস্ত্রের ওপর মনোযোগ দেওয়া শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ মেনে নেবে না’। তার মতে, এর সমাধান হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমেই সম্ভব। তিনি আরও যোগ করেন, ‘এর মহাসচিব নাইম কাসেম ঠিকই বলেছেন যে এই গোষ্ঠীর অস্ত্র তার সমর্থকদের আত্মার মতো’।

জুমব্লাত উল্লেখ করেন, ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে তাদের সামরিক অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে। জাতিসংঘের প্রস্তাবের অধীনে লিতানি নদীর দক্ষিণে আংশিক নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব হয়েছে জানিয়ে তিনি জনবল, সরঞ্জাম ও বেতন বৃদ্ধি করে লেবাননের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেকোনো নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলি প্রত্যাহারও সমান্তরালভাবে চলতে হবে’। অতীতে যেভাবে সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল, তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে বিষয়েও তিনি সাবধান করেন।

এদিকে, বুধবার হিজবুল্লাহর নেতার রাজনৈতিক সহযোগী হুসেইন আল-খলিল ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার মারাত্মক ফাঁদ’ পাতার অভিযোগ করেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার তথ্যমতে, তিনি অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নষ্ট করে দেশটিকে ‘একটি মার্কিন-ইসরায়েলি উপনিবেশে’ পরিণত করার চেষ্টা করছে।

মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের সময় লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালাম রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, অস্ত্রের ওপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং যুদ্ধ ও শান্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রের হাতে রাখার প্রক্রিয়া ‘শুরু হয়েছে এবং এ থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই’।

উল্লেখ্য, গত জুনে মার্কিন দূত ব্যারাক হিজবুল্লাহর নিরস্ত্রীকরণের সঙ্গে পাঁচটি বিতর্কিত সীমান্ত চৌকি থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার এবং পুনর্গঠন তহবিল ছাড় করার একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লেবাননের মন্ত্রিসভা এই মাসের শুরুতে প্রস্তাবের ‘উদ্দেশ্য’ অনুমোদন করে, যার মধ্যে রাষ্ট্রের হাতে অস্ত্র থাকার নীতিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পদক্ষেপের ফলে হিজবুল্লাহর সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়, কারণ তারা ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের আগে নিরস্ত্র হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলার জেরে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত গোলাগুলি শুরু হয়, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পুরোদস্তুর যুদ্ধে রূপ নেয়। এই সংঘাতে ৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং প্রায় ১৭ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। নভেম্বরে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও, ইসরায়েলি বাহিনী এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালিয়ে আসছে এবং হিজবুল্লাহর কর্মকাণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করার দাবি করছে। যুদ্ধবিরতির অধীনে জানুয়ারির মধ্যে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের কথা থাকলেও, দেশটি শুধু আংশিকভাবে সেনা সরিয়েছে এবং পাঁচটি সীমান্ত চৌকিতে তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে।