গাজায় যুদ্ধবিরতি: নিজ বাড়িতে ফিরেও স্বস্তি নেই ফিলিস্তিনিদের

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ায় বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজা শহরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে একসময়ের প্রাণচঞ্চল এই শহর এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দেন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পুরো শহরটি দখলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেখানে ব্যাপক বিমান হামলা ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ১০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির আবাসস্থল এই শহরটিতে ইসরায়েলি বাহিনী একের পর এক উঁচু ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যা একসময় গাজার উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল। এই নৃশংস হামলায় সমুদ্রতীরবর্তী শহরের রেস্তোরাঁ, ক্যাফে এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রথম পর্যায়ে শহরের পূর্বাঞ্চলের বড় একটি অংশ ধ্বংস করা হয়। সম্প্রতি সামরিক অভিযানটি পশ্চিম দিকে পরিচালিত হয়, যেখানে অন্তত ১৪টি উঁচু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই সময়ে শহরের অন্যতম পরিচিত স্থাপনা মুশতাহা টাওয়ারসহ দশ তলার চেয়েও উঁচু বেশ কয়েকটি ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, হামাস গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজে উঁচু ভবনগুলো ব্যবহার করত। তবে এই দাবির পক্ষে তারা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেয়নি। হামাস বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

১৪ তলা আল-জুনদি আল-মাজহুল টাওয়ারের বাসিন্দা উইসাম শুবলাক কয়েক দশক ধরে সেখানে বাস করতেন। তিনি জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তার বাড়িতে প্রথম হামলা হয় এবং গত মাসে ভবনটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি জানালায় মিশে ছিল স্মৃতি। এখানে আমরা হেসেছি, কেঁদেছি, বড় হয়েছি।’

এই হামলায় আল-রুয়া টাওয়ার-১ ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে একসময় অনেক ক্যাফে, দোকান ও সৃজনশীল কাজের জায়গা ছিল। তুরস্ক থেকে ফিরে রিস্ট্রেটো ক্যাফে খোলা আবদুল্লাহ আল-সাফাদি জানান, তার চোখের সামনেই টাওয়ারটি সম্পূর্ণ ধসে পড়ে।

এমনকি গাজার গণমাধ্যমের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত আল-গিফারি টাওয়ারও রক্ষা পায়নি। সিজিটিএন-এর সংবাদদাতা নূর হারাজিনের মতো অনেক সাংবাদিক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের কার্যালয় ছিল এই ভবনে। নূর বলেন, ‘এটি হৃদয়বিদারক। ভাবুন তো, যে ভবনে আপনি আপনার কর্মজীবনের এক দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন, সেটি চোখের সামনে ভেঙে পড়তে দেখা কতটা কষ্টের।’

জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী, দখলকৃত এলাকায় বেসামরিক সম্পত্তি ধ্বংস করা নিষিদ্ধ, যদি না ‘সামরিক অভিযানের জন্য অপরিহার্য’ হয়। জাতিসংঘের একটি কমিশন ইসরায়েলের এই ধরনের হামলাকে গাজায় সংঘটিত গণহত্যার প্রমাণ হিসেবে পর্যালোচনা করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার ঘোষণা করেন, ইসরায়েল ও হামাস ২৯ সেপ্টেম্বর তার দেওয়া ২০-দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে, প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং গাজা উপত্যকা থেকে পর্যায়ক্রমে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে।

চুক্তির প্রথম পর্যায়টি স্থানীয় সময় শুক্রবার দুপুর ১২টায় কার্যকর হয়েছে। পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে হামাসের অংশগ্রহণ ছাড়া গাজায় একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ফিলিস্তিনি এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সেনাদের নিয়ে একটি নিরাপত্তা বাহিনী গঠন এবং হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭,৬০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই আগ্রাসনে পুরো উপত্যকাটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।