শশী থারুর: ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধস

মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্য বিক্রি এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কের হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করেছেন, যার ফলে অনেক পণ্যের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের রপ্তানি আয়ের একটি বড় উৎস ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজার, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে ভারতীয় পণ্যের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, সাধারণ ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে কংগ্রেস পার্টির এমপি শশী থারুর এক কলামে এই সংকটের গভীরতা তুলে ধরেছেন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি হিসেবে এই মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। অথচ আগস্টেও এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত ছিল অক্টোবর মাসেও, যেখানে আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৯ শতাংশ।

শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে ভারতের গয়না ও রত্নশিল্পে। মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজ ইলেকট্রনিকস এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (এসইইপিজেড) থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রত্ন ও গয়নার রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ৭১ থেকে ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। হাজার হাজার পোলিশ শ্রমিক, কারিগর এবং ছোট উদ্যোক্তা এখন কর্মহীন হওয়ার শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। হঠাৎ করে অর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবিকা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

ভারতের পোশাক খাতও বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। এই খাতে লাভের হার সাধারণত খুব সামান্য থাকে, যা অনেক সময় এক অঙ্কের ঘরেই সীমাবদ্ধ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছিল, যা দেশটির মোট পোশাক রপ্তানির ৩৫ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে এই পণ্যের ওপর শুল্ক ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে এক লাফে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে ভারতীয় পোশাক কার্যত মার্কিন বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে।

ভারতের এই সংকটের সুযোগে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ডেনিম, পোশাক এবং কৃত্রিম তন্তুর সরবরাহ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান বিশ্ববাজারে ফ্লিস ও ডেনিম উৎপাদনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। মেক্সিকো ও সিএএফটিএ-ডিআর জোটভুক্ত দেশগুলো ভৌগোলিক নৈকট্য এবং শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে মার্কিন খুচরা বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। এমনকি কম্বোডিয়াও ফ্যাশন পণ্যের উদীয়মান কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে।

কার্পেট ও গালিচা শিল্পের অবস্থাও নাজুক। এই খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ রপ্তানিই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যেত। কিন্তু শুল্ক ২ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ করায় মার্কিন ক্রেতারা এখন তুরস্ক ও চীনের দিকে ঝুঁকছেন। এমনকি মিসরে অবস্থিত তুরস্কের মালিকানাধীন কারখানাগুলো থেকেও পণ্য সংগ্রহ করছেন তারা। চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও একই দশা। ২০২৪-২৫ সালে ভারতের মোট চামড়া রপ্তানির ২১ দশমিক ৮ শতাংশই গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, যা এখন কার্যত বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

অনেক রপ্তানিকারক শুল্ক বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে আগেভাগেই পণ্য পাঠিয়েছিলেন। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ১৩ শতাংশ বেড়ে ৪৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই সাময়িক উচ্ছ্বাস এখন মিলিয়ে গেছে এবং নতুন অর্ডারের অভাবে কারখানাগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে বৈশ্বিক রপ্তানিতে ভারতের অংশ ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা এখন হুমকির মুখে।

এই সংকট কাটাতে ভারতের সামনে এখন বাজার বহুমুখীকরণ ছাড়া উপায় নেই। শশী থারুরের মতে, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চামড়া ও বস্ত্রের বাজার খুঁজতে হবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে একীভূত আঞ্চলিক টেক্সটাইল ও সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। যদিও বর্তমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতায় এটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ।